আবাসিক এলাকায় সিসা কারখানার ছড়াছড়ি

0
92

নিয়মকানুন না মেনেই খুলনা নগরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় অন্তত ৩০টি সিসা কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, এ ধরনের পদার্থ মানুষের শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগ ও ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর কোনো পশু কারখানার আশপাশের ঘাস খেলে অসুস্থ কিংবা মারাও যেতে পারে।
খুলনা নগরে ইজিবাইকের প্রচলন বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বিস্তার ঘটছে সিসা কারখানারও। আবাসিক এলাকা রূপসা, লবণচরা, হরিণটানা, তেঁতুলতলা, সুড়িখালী, হোগলাডাঙ্গা, শোলমারী, আড়ংঘাটা, বিল পাবলা, রায়েরমহল ও শিরোমণি এলাকায় গড়ে উঠেছে অবৈধ সিসা কারখানা।
গতকাল শনিবার নগরের শিরোমণি এলাকায় একটি কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, প্রাচীরবেষ্টিত একটি উঁচু টিনের ঘর। পাশে একটি উঁচু চিমনি। ঘরের মধ্যে গর্ত করে মাটির চুলার মতো চুল্লি বানানো হয়েছে। সিসা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জানান, পরিত্যক্ত ব্যাটারির কোষগুলো সিমেন্টের মতো জমাট বেঁধে যায়। চুল্লির মধ্যে কাঠ ও কয়লা দিয়ে পরতে পরতে অ্যাসিডমিশ্রিত জমাট বাঁধা বর্জ্য সাজানো হয়। এরপর আগুন ধরিয়ে দিয়ে একটি পাম্পের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক পাখা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বাতাস দেওয়া হয়। কাঠ ও কয়লা পুড়ে একটি আগুনের কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়। সিসা পুড়ে তরল হয়। এরপর একটি লম্বা চামচ দিয়ে বর্জ্য সরিয়ে সিসা লোহার তৈরি কড়াইতে রাখা হয়। ঘন ধূসর ধোঁয়া চিমনি দিয়ে বের হয়ে যায়।
আবদুল মজিদ নামের এক শ্রমিক বললেন, বাস ও ট্রাকের একটি পরিত্যক্ত ব্যাটারি থেকে গড়ে ২২-২৩ কেজি এবং ইজিবাইকের পরিত্যক্ত ব্যাটারি থেকে ৬-২৩ কেজি পর্যন্ত সিসা পাওয়া যায়।
এভারেস্ট মেটাল ও ব্যাটারি কোম্পানির মালিক কাজী মেহেদি হাসান বলেন, ‘আমার কারখানার লাইসেন্স আছে।’ তিনি জানান, সিসা চকচক করে। দিনের বেলা সিসা ও বর্জ্য চেনা যায় না। এ জন্য রাতে সিসা গলানো হয়।
সুড়িখালী এলাকার বাসিন্দা বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘সিসা ফ্যাক্টরিগুলো সারা দিন বন্ধ থাকে। মধ্যরাতে গাড়িতে করে মালামাল এনে কাজ শুরু হয়। আবার ভোর হওয়ার আগেই কাজ শেষ হয়ে যায়। রাতে কাজ করার সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।’
শিরোমণি এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সিসা ফ্যাক্টরির কারণে গাছপালার পাতা বিবর্ণ হয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। নানা রোগবালাই দেখা দিচ্ছে।’
খুলনার সিভিল সার্জন ইয়াছিন আলী সরদার বলেন, সিসা উচ্চ তাপমাত্রায় গলানোর সময় সহযোগী হিসেবে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর যৌগ উৎপাদিত হয় এবং তা দ্রুত বাতাসের সঙ্গে চারদিকে এক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পরিবেশ দূষিত হয়। আশঙ্কা দেখা দেয় অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগ ও ক্যানসারের মতো রোগের।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আনোয়ারুল ইসলাম জানান, অনেক সময় ছাইয়ের সঙ্গে বিষাক্ত সিসা বাতাসে উড়ে গিয়ে পাশের জমিতে পড়ে। বিশেষ করে শীতকালে উড়ে যাওয়া সিসা পাশের জমিতে পড়লে আর স্থানান্তরিত হয় না। ফলে ওই স্থানে জন্মানো ঘাস কোনো পশু খেলে অসুস্থ হতে পারে।
২০০৭ সালে নগরের বুড়ো মৌলভীর দরগা এলাকায় এমনভাবে একসঙ্গে ১২টি গরু মারা যায়। নগরে কমপক্ষে ৩০টি সিসা কারখানা আছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিসা কারখানা গড়ে তোলা পরিবেশ আইনে একেবারেই নিষিদ্ধ। আমরা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু তারা অন্য এলাকায় গিয়ে আবার এটা শুরু করে। তাই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন।’

LEAVE A REPLY