কুষ্টিয়ার শিক্ষাঙ্গন জ্ঞান বাগানের মালী নাসির মাস্টারের গল্প

0
519

রনি অাহমেদ, বিশেষ সংবাদদাতা :জীবনের শেষ অর্জনটা দিয়ে শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়ে নাসির মাষ্টারের বাড়ি এখন শিশুতোষ জ্ঞানভান্ডারে পরিণত হয়েছে। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর আলোকিত মুখ নাসির মাষ্টার পেনশনের টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছেন শিশুদের শিক্ষা বিনোদনকেন্দ্র, পাখিদের অভয়াশ্রম, ঔষধি গাছের চারা, ফলজ, বনজসহ বিভিন্ন বৃক্ষের বাগান।

মহান এই মানুষটির পাঠাগারের সংগ্রহশালায় রয়েছে পুরাতন তথ্যবহুল পেপার কাটিং এবং মণিষীদের বাণীসহ দুর্লভ অনেক কিছু। উপজেলার কয়া গ্রামের নাসির উদ্দিনের বাড়িটি যেন সবসময় জ্বলে শিক্ষার প্রদীপ। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর কয়া গ্রামের আলোকিত মানুষ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত নাসির উদ্দিন মাষ্টার। ১৯৬৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণের পর নাসির মাষ্টার নিজ হাতে গড়ে তোলেন শিশুদের বিনোদন পার্ক, হরেক রকমের ফুল, ফল ও ঔষধি গাছের বাগান।নাসির মাস্টারের শিশু পার্কে শিশুদের আনন্দে মেতে ওঠার দৃশ্য তাঁর মায়ের নামেই নামকরণ করা হয়েছে ‘কুলছুম নেছা শিশু পার্ক ও পাঠাগার’।

শিশুদের খেলার সরঞ্জামাদি ও বই এর লাইব্রেরী। প্রায় দশ বছর আগে তিনি শিশুদের জন্য নিজের বসতবাড়ির আঙ্গিনায় গড়ে তুলেছেন একটি শিশুতোষ বিনোদন কেন্দ্র। এলাকার মানুষের কাছে জ্ঞানের বাগান হিসেবে পরিচিত। এই বাগানটিতে রয়েছে হরেক রকমের ফুল-ফল আর ঔষধি গাছ। প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এই বাগানের গাছের পরিচর্যা করে আসছেন বলে জানান নাসির মাষ্টারের সহধর্মীনি মরিয়ম বেগম।

শিশুদের গাছের সাথে পরিচিতি ঘটানোর লক্ষে লেমিনেটিং করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে নাম এই বাগানেই শিশুরা খেলা করে আর নানা ধরণের বই পড়ে। শিশুদেরকে গাছের সাথে পরিচিত করতে কাগজে নাম লিখে লেমিনেটিং করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিটি গাছের গায়ে। যাতে শিশুরা গাছ সহজে চিনতে পারে। এ ছাড়াও গুণী মণিষীদের বাণী কাগজে লিখে লেমিনেটিং করে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন গাছে গাছে।

দেশীয় নানা প্রজাতির পাখির সাথে শিশুদের পরিচিতি ঘটাতে বাগানের বড় গাছগুলোতে পাখিদের বাসা বানানোর জন্য হাঁড়ি ঝুলিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়াও বাগানের ভিতরের একটি জায়গায় পানি রেখে দেওয়া হয়েছে পাখিদের গোসলের জন্য। শিশুরা স্কুল শেষ করে বিকেলে চলে আসে এখানে অনেক দোলনা আরও অনান্য খেলার সামগ্রী এবং অনেকে মাটিতেই খেলতে শুরু করে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহি নানা ধরণের খেলা।

শিশুরা যেন বাংলা শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারে এ জন্যে হরেক রকমের বাংলা শব্দের উচ্চারণ করানো হয়। এখানে শিশুরা যে শুধুমাত্র পাঠ্য বই পড়ে- তা কিন্তু নয়। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি তাদের পড়ানো হয় নানাধরণের শিশুতোষ গল্পের বই। নাসির মাষ্টারের বাগানে বসে শিশুরা ছবিও আঁকে। বর্তমানে শুধু এলাকার মানুষই নয়, দূর-দূরান্তের অনেকেই প্রয়োজনে ছুটে যান নাসির মাষ্টারের বিনোদন বাগানে।

পুরাতন পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও প্রবন্ধের কার্টিং সংরক্ষণ করে রেখেছেন নাসির মাস্টার
কেননা তিনি বহু পুরাতন পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও প্রবন্ধের কার্টিং সংরক্ষণ করে রেখেছেন খুবই যত্ন করে। যার মধ্যে রয়েছে গুণী মণিষীদের জীবনীসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ। তথ্যসমূহের ফাইলগুলো সর্বস্তরের মানুষের জন্যে উন্মুক্ত করে রেখেছেন তিনি।

বসতবাড়ির একটি কক্ষে নিজের মায়ের নামে কুলছুম নেছা পাঠাগার নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করেছেন। পাঠাগারটিতে দেশীয় বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত গুণী ব্যক্তিদের তথ্য ও ছবির সমাহার।

১৯৪৬ সালে কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের কয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নাসির উদ্দিন। দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করাকালীন সময়েই তিনি নিজের গ্রামে শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্যে বন্ধুদের সাথে নিয়ে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে এলাকার বিভিন্ন বয়সের অশিক্ষিত মানুষকে মৌলিক বর্ণমালা শিক্ষা দান করতেন।

এখনো নাসির মাষ্টার তার কাঁধে ঝোলানো লম্বা ফিতার ব্যাগের মধ্যে স্লেট এবং চক নিয়ে ঘুরে বেড়ান নিরক্ষর মানুষের সন্ধানে।

নাসির মাষ্টার বলেন, এই কাজে আমাকে সহযোগিতা করেন সাউথ ইষ্ট ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রকিবুল ইসলাম ও মিলন হাসানসহ গ্রামের কিছু মানুষ।

আমি এই কাজগুলো করার মাঝে আনন্দ খুঁজে পাই। আর শিশুদের সাথে খেলাধুলা করতেও আমি খুব স্বাচ্ছন্দবোধ করি।

আলোর মানুষ, আলো বিলিয়ে দেওয়া মানুষ, সদা সাদা মনের মানুষ-যিনি সমাজে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব বহন করে চলেছেন। মহান এই মানুষটির কর্মকান্ডে যেন প্রতিটি মানুষ এগিয়ে এসে জ্ঞান বিলাবে- এমনটিই প্রত্যাশা জ্ঞান বাগানের মালী নাসির মাস্টারের।

LEAVE A REPLY