মানুষের চেয়ে গরু দামি!

0
70

বিনা মূল্যে গরুর খাবার দেওয়া হবে—গত ডিসেম্বরে এমন ঘোষণা দেয় উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখন্ডের স্থানীয় এক কলেজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ ঘোষণা দিয়ে কেবল একটা পোস্ট দেওয়া হয়। তিন শর মতো গরুকে খাওয়ানোর ইচ্ছে ছিল কর্তৃপক্ষের। তবে ঘটনার দিন এক এলাহি কাণ্ড। বিভিন্ন এলাকা থেকে খামারিরা নিয়ে আসেন ৭ হাজার গরু। আরও ১৫ হাজার গরু নিয়ে আসা খামারিদের রীতিমতো মারধর করে বিদায় করে পুলিশ ও কলেজের কর্মচারীরা। হুটোপুটি, কোলাহল, মারধরে মারা যায় কয়েকজন। ওই জায়গাতেই আত্মহত্যা করেন উত্তর প্রদেশের এক কৃষক। হতভাগ্য ওই কৃষকের অভিযোগ ছিল, মানুষের ফেলে যাওয়া গরু তাঁর খেতের ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। দুই লাখ রুপি ধার করে আবাদ করেছিলেন। কিন্তু এখন খাবার নেই, কিন্তু রয়েছে ঋণের খড়্গ। সেই কষ্টেই পৃথিবী ছাড়লেন তিনি।

এই হলো ভারতের গোরক্ষা নীতির হালনাগাদ প্রভাব। শুধু উত্তর প্রদেশ নয়, ভারতজুড়েই গোরক্ষার নামে চলছে অরাজকতা। সরকারের ধর্মীয় রাজনীতি এখন বুমেরাং হয়ে সরকারের ওপরই আঘাত হেনেছে। ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম গরু পুষে বিপাকে পড়া গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে নিয়মিত লিখছে। সম্প্রতি ভারতের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ইন্ডিয়া টুডে এ ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার সংগঠন পিইউডিআর তাদের প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, গোরক্ষার নামে কীভাবে অপরাধ ও অপরাধের অর্থনীতির বিস্তার ঘটছে ভারতে।

মোদি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার পর গরু বিক্রি নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আতঙ্ক। দুধ দেওয়ার ক্ষমতা হারানো বয়স্ক গাভি নিয়ে বিপাকে পড়ছেন খামারিরা। খাওয়াতে ব্যয় করতে হয়, অথচ আয় নেই। অনেক খামারি তাই চুপিচুপি রাস্তায় ছেড়ে আসেন অনুৎপাদনশীল গাভি ও বলদ। রাস্তায় থাকা এসব পশু খাবারের খোঁজে হানা দেয় কৃষকদের জমিতে। নষ্ট করে ফসল। ধারদেনা করে চাষ করেন কৃষকেরা। খেতের ফসল নষ্ট হলে নিরুপায় হয়ে পড়েন তাঁরা।

আর এই আতঙ্কে বাতাস দিচ্ছে বিজেপি সরকার ও তাঁর সমর্থক কথিত গোরক্ষকেরা। ২০১৪ সালে বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গোহত্যা বন্ধ নিয়ে কাজ করা কট্টরবাদী সংগঠনগুলো অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর থেকে গরু ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনও আগের চেয়ে বেড়ে যায়। গত বছরের মে মাসে গোহত্যা বন্ধে সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকরে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা দিয়ে বা অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গরু নিয়ে চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, গরু বা মহিষ নিয়ে কোথাও যাওয়ার সময় সঙ্গে কর্তৃপক্ষের দেওয়া সনদ থাকতে হবে যে ‘ওই পশুকে জবাই বা খাওয়ার উদ্দেশ্যে বিক্রি করার জন্য নেওয়া হচ্ছে না।’

২০১৪ সালে বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গরু হত্যা বন্ধ নিয়ে কাজ করা কট্টরবাদী সংগঠনগুলো অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছবি: রয়টার্স২০১৪ সালে বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গরু হত্যা বন্ধ নিয়ে কাজ করা কট্টরবাদী সংগঠনগুলো অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছবি: রয়টার্স

কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের রাজনীতির কারণে আসলে বিপাকে পড়ছে কে? ভারতের গুজরাট, ছত্তিশগড়, উত্তর প্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশে এখন মানুষের চেয়ে গরু অধিক নিরাপদ। কার সাধ্য গরুর গায়ে আঁচড় দেয়! আগে এসব রাজ্যে গ্রামের সাধারণ মানুষ গরু পুষত কিছু আয়ের জন্য। সাধারণত গরুর দুধ, গোবর বেচে কিছু অর্থ আসে। যেসব গরু দুধ দেয় না, সেগুলো বিক্রিও করা যেত। তবে এখন যা পরিস্থিতি, গরুর খাদ্য জোগাড় করতে গেলে লোকজনকে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, মধ্যপ্রদেশে গরুর সংখ্যা এখন প্রায় দুই কোটি। অর্থাৎ প্রতি তিনজন মানুষে একটা গরু আছে। এসব গরুর ৫০ ভাগের অর্থকরী মূল্য নেই, অথচ এগুলো বিক্রিও করা যাচ্ছে না, আবার পুষতেও খরচ হচ্ছে ব্যাপক।

ইন্ডিয়া টুডের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কৈলাস নায়েক মধ্যপ্রদেশের ভোপাল জেলার থান্ডা গ্রামের এক কৃষক সাত মাস হলো ঘরবাড়ি ছেড়ে নিজের গমখেতের দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটা ঘরে থাকছেন। এ যেন আসমানির সেই ছোট্ট কুঁড়ে। ‘একটু খানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি’, শীতেও কাঁপতে হয় ঠকঠক করে। তবে একেবারেই নিরুপায় কৈলাস। কারণ, লাগামছাড়া গরুর দল কখনো ফসলের খেতে হানা দেবে না, কেউ বলতে পারে না। তাই খেতের দিকে নজর না দিলে হারাতে হবে ফসল। সারা বছর থাকতে হবে ভুখা। শুধু কৈলাস নয়, এমন অবস্থায় রয়েছেন হাজার হাজার কৃষক, যা ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিকে বিরাট ধাক্কা দিচ্ছে।

সরকারের গোরক্ষার নীতির ফলে গরু প্রাণে বাঁচছে বটে, তবে মাংস, চামড়া রপ্তানিসহ সামগ্রিকভাবে চামড়াশিল্পই মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও স্বীকার করছে, গত কয়েক বছরে ভারতের মাংস ও চামড়া রপ্তানির পরিমাণ অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। শুধু তা-ই নয়, নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পশুর ওষুধ, বোতাম, রঙের ব্রাশ, টুথপেস্টসহ অনেক শিল্পে, যেগুলোর মূল উপাদান হিসেবে পশুর হাড়ের ব্যবহার করা হয়। ভারত ছিল বিশ্বের প্রধান মাংস রপ্তানিকারক দেশ। এখন সেই স্থান দখল করে নিয়েছে ব্রাজিল। শুধু এটুকু হলেও হতো, যদি না ছেড়ে দেওয়া গরুর হামলায় নষ্ট হতো শত শত হেক্টর জমির ফসল।

তবে এ নিয়ে সরকার যেন একদম চুপ। ভাবছে অন্য উপায় নিয়ে। একটি অযৌক্তিক নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে মনোযোগ দিচ্ছে গোশালা তৈরিতে। কেন্দ্রীয় মোদি সরকারকে খুশি করতে রাজ্য সরকারগুলো কোটি কোটি রুপি বরাদ্দ রাখছে গরুর কল্যাণে। বর্তমানে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানায় গোশালার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। আরও অসংখ্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে গোশালা তৈরির। সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, উত্তর ভারতের বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারের বাজেটের বড় ব্যয় হচ্ছে গরুর কল্যাণে। শুধু সরকারিভাবেই নয়, বেসরকারি তহবিলও আসছে। যেসব কোম্পানি ২০১৪ সালের আগে কখনো গোরক্ষায় ভূমিকা রাখেনি, তারাও এখন সরকারকে খুশি করতে বিশেষ তহবিল নিয়ে এগিয়ে আসছে। করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অংশ হিসেবে গরুর কল্যাণে ফান্ড দিচ্ছে টাটা পাওয়ার ও আলেম্বিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি।

তবে এত সব বরাদ্দ দিয়েও কি শেষরক্ষা হচ্ছে? অভয়াশ্রমের অস্বস্তিকর পরিবেশের কারণে শত শত গরু মারা যাচ্ছে। ছড়াচ্ছে রোগবালাই। ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, গত আগস্টে বিএসপি নেতা মায়াবতী অভিযোগ করেন, গোশালাগুলোর অবস্থা কসাইখানার চেয়েও খারাপ। অস্বস্তিকর পরিবেশের কারণে এখানে যে পরিমাণ গরু মারা যাচ্ছে, কোনো কসাইখানাতেও এতটা মারা হয় না। তিনি উল্লেখ করেন, জয়পুরে এক আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ দিনে ৫০০ গরু মারা গেছে। গত সেপ্টেম্বরে মধ্যপ্রদেশে তৈরি হয় দেশের প্রথম ‘কামধেনু আশ্রম’। ৩২ কোটি রুপি ব্যয়ে ৪৭২ হেক্টর জমির ওপর তৈরি হয় ওই আশ্রম। অথচ তৈরির এক মাসের মাথায় পলিথিন খেয়ে মারা যায় ১০০ গরু। মধ্যপ্রদেশের বিরোধী দলের নেতা অজিত সিং অভিযোগ করেন, গরু কল্যাণের নামে ভণ্ডামি করছে বিজেপি সরকার।

ভারতের নারী ও শিশু উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী মানেকা গান্ধী গত ডিসেম্বরে এই বিষয়ে একটি ‘ম্যানুয়েল’ প্রকাশ করেন। অর্থনীতিতে এসব অনুৎপাদনশীল গরুর অর্থকরী মূল্যের দিকটি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশ্বের অনন্য দেশে অর্থকরী মূল্যহীন গরু মেরে ফেলা হয়। ভারতে এগুলো মারা হচ্ছে না, তবে অস্বাস্থ্যকর ভয়াবহ পরিবেশে রাখা হচ্ছে। খামারিরা এসব গরু পালতে না পেরে ফেলে যাচ্ছেন। আর এগুলো খাদ্যের খোঁজে ফসল নষ্ট করছে। কৃষকের খাবারে হাত বসাচ্ছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত পিপলস ইউনিয়ন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটসের (পিইউডিআর) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারতে গোরক্ষার নামে বাড়াবাড়ির মোট ১৩৭টি ঘটনা ঘটে, যাতে মৃত্যু হয় ২৯ জনের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে যেভাবেই হোক গরু রক্ষা করতে হবে। সে মানুষ মেরে হোক, কৃষকের জীবন ফসল নষ্ট করে হোক। গরু রক্ষায় বিজেপি সরকারের প্রচেষ্টা দেখলে এমনটা ভেবে নেওয়া যায় যে মানুষের চেয়ে গরুর মূল্য বেশি। বাজেটেও গরুর কল্যাণে বরাদ্দ থাকছে বেশি। সরকার হয়তো ভাবছে কট্টর হিন্দুবাদী মনোভাব দিয়েই জয় আসবে। সম্প্রতি ত্রিপুরাতে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে বিজেপি। এই বিজয় হয়তো দলটির আস্থা বাড়িয়েছে। কিন্তু সেখানে বিজেপির এক শীর্ষ নেতা ঘোষণা করেছেন, ত্রিপুরায় গোমাংস নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। ফলে গোমাংস বিষয়ে দলটির দ্বিচারী মনোভব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

তবে গরুর কল্যাণ ভাবতে ভাবতে বিজেপি সরকারকে এটাও ভাবতে হবে, যে ব্যাপক জনরোষের সৃষ্টি হচ্ছে, তা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে তো? সম্প্রতি টানা পাঁচ দিন হেঁটে ১৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের ৩০ হাজার কৃষক মুম্বাই পৌঁছান। গরু বিক্রি নিয়ে সরকারি কড়াকড়ি বন্ধ অন্যতম দাবি ছিল তাঁদের। এসব প্রতিবাদ কি সরকারকে ভাবাচ্ছে না? কারণ, গরু নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতি থাকলেও মনে রাখতে হবে গরুর কিন্তু ভোট নেই!

সুত্রঃ প্রথম আলো অনলাইন ।

LEAVE A REPLY