মিজানুর রহমান নয়ন, কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি ঃ জসিম উদ্দিন পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। তার বয়স ৩৩ বছর ।অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারনে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেনী টপকাতে পারিনি জসিম।কিন্তু পড়ার প্রবল ইচ্ছা আর জ্ঞানার্জনের নেশা তার আজীবনই স্বপ্নের মত থেকে যায়।প্রতি নিয়ত তাড়া করে বেড়াই না পড়ার দুঃখ,কষ্ট আর যন্ত্রনা,ছুটে যেতে মন চাই আবার সেই প্রাইমারি স্কুলে।তা হয়তো আবারও স্বপ্ন হয়ে তাড়া করবে।
তাইতো নিজের ও পিছিয়ে পরা মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে এবং আলোকিত মানুষ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজ খরচে গড়ে তুলেছেন একটি উন্মুক্ত লাইব্রেরী।যাহার নাম করন করা হয়েছে কমিউনিটি লাইব্রেরী।ছোট বড় বৃদ্ধ সমস্ত শ্রেনী পেশার মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বই আছে লাইব্ররীতে।
জানা যায়,নিজের ও কিছু বাজার থেকে কেনা প্রায় ১শত বই নিয়ে ২০১৬ সালে বাঁশ খুটি আর টিনের তৈরি লাইব্রেরীতে বর্তমানে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৬ শতাধিক এবং পাঠক সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ শতাধিক।
জসিম কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের মোতালেব শেখের পুত্র।
জানা যায়, স্ত্রী, ৫ বছরের এক মেয়ে, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক ভাই ও মা’সহ ৫ জনের পরিবারে তিনি একাই উপার্জন করেন। বাবা ছোটবেলায়ই তাদের ফেলে কোথায় যেন চলে গেছেন। বলার মতো নিজের অর্থ-সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই, আছে একটা প্রশস্ত মন। যে মন মানুষকে আলোকিত করার স্বপ্ন দেখে। ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর তিনি নিজ উদ্যোগে একটি পাঠাগার স্থাপন করেছেন ‘কমিউনিটি লাইব্রেরি’ নামে।
তিনি বই কেনেন নিজের খরচে, সদস্য সংগ্রহও করেন বিনা পয়সায়। এখানের সদস্যদের তিনি নানারকম বই পড়তেও দেন বিনামূল্যে। তার বিশ্বাস, গ্রামের কম শিক্ষিত মানুষগুলো বইপড়ার মাধ্যমে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবেন, ইচ্ছে থাকলে ভালো কিছু করা সম্ভব। এ পাঠাগারে যারা পড়তে আসেন বা বই ধার নেন তারা কেউই একটি মাত্র শ্রেণির নন। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই। তার ভাষায়, ‘শুধুমাত্র স্কুলের ছেলেমেয়েরা নয়, যারা অনার্সে পড়ে তারাও আমার লাইব্রেরি থেকে বই নেয়। এমনকি বয়স্ক ও যেসব মেয়ের কিছুদিন হলো বিয়ে হয়েছে তারা সবাই আসে, বই নেয়। আমার মতো খেটে খাওয়া মানুষরাও আসেন।’
লাইব্রেরি সবার জন্য উন্মুক্ত হলেও তিনি মূলত অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত মানুষদের বই পড়ানোর চিন্তা থেকেই এই পাঠাগারটি স্থাপন করেছেন। তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি তো একজন কাঠমিস্ত্রী, আয় স্বাভাবিকভাবেই কম, এরপর মাথার ওপর আপনার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছোট ভাই, কেমন করে সাহস হলো আপনার এই উদ্যোগ নিতে? তিনি বলেন, ‘আসলে কেমন করে উদ্যোগটা নিয়ে ফেলি সেটা সেটা আমি নিজেও জানি না। তবে ছোটবেলায় আমার পড়ার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল, কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার কারণে আর তা হয়নি। সংসারের ভার নিতে হয়। আমি মাঝে মাঝে বই সংগ্রহ করে পড়তাম, অন্যকে পড়তে দিতাম। ধীরে ধীরে এর পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং এক সময় এ রকম একটা লাইব্রেরি গড়ার সিদ্ধান্ত নেই।
পাঠাগারটিতে মাসিক খরচ সম্পর্কে তিনি জানান, ঘর ভাড়া ২০০, বিদ্যুত্ বিল ১০০ এবং একটি জাতীয় দৈনিক রাখেন, যার জন্য তাকে আরও ৩০০ টাকা খরচ করতে হয়। এছাড়াও পত্রিকার বিভিন্ন নিবন্ধ ফটোকপি করাসহ আরও কিছু টাকা খরচ করতে হয়, যা হিসেবের বাইরে থাকে। কারও কাছ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা পাননি। তবে একটি সহযোগিতার কথা তিনি বলেন, তা হলো লাইব্রেরিতে মানুষের আসা-যাওয়া। কেউ তাকে তেমনভাবে সাহায্য না করলেও তার কর্ম নিয়ে অনেকেই ঠাট্টা বিদ্রুপ করেন। অনেকেই তাকে পাগল বলেন। নিজেই যেখানে দিন এনে দিন খেতে পারে না সেখানে তিনি মানুষকে বই পড়ান। আর এ নিয়েই বিদ্রুপ। শুধু কি মহল্লার লোকজন? না, তার পরিবারও চায় তিনি যেন আর বই না কেনেন, অভাবের সংসার। তবে স্ত্রী কিংবা মা, কেউই তা মুখে বলেননি, তবে বুঝতে পারেন জসিমউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আসলে এটাই বাস্তব যে, কেউই চায় না টানের সংসারে অর্থ অতিরিক্ত কোনো খাতে খরচ হোক। তেমনই আমার পরিবারও চায় না, কিন্তু আমি বুঝি। আর আত্মীয়স্বজনও আশেপাশে থাকা মানুষদের মতোই কেউ ভালো বলেন, কেউ খারাপ বলেন।’
তিনি মনে করেন করেন, লোকের কথা লোকে বলবেই। অনেক সময় আপত্তিকর কথা বলবে, আবার প্রশংসা করবে। কোনো এনজিও থেকে সাহায্য পেয়েছেন কি-না? এমন প্রশ্নে তিনি জানান, সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহযোগিতা তিনি পাননি, তবে একজনের পরামর্শে স্থানীয় ইউএনও বরাবর একটি চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু তার উত্তরও পাননি। তবে যেকোনোরকমের সাহায্য তিনি গ্রহণ করবেন তার পাঠাগারের উন্নতির স্বার্থে। পত্রিকায় কলাম লেখেন এমন কয়েকজনের ই-মেইল ঠিকানা পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করে বই চেয়েছেন। হাতে গোনা দু-তিনজন দিয়েছেনও কিছু বই। এরমধ্যে মুহাম্মদ জাফর ইকবালও রয়েছেন বলে জসিমউদ্দিন জানান। কিন্তু প্রথম তিনি যার নজরে আসেন তিনি হলেন মাছুম বিল্লাহ নামের একজন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ও কলামিস্ট। অবশ্য তার কাছেও এই বই পাগল ই-মেইল করেছিলেন।
দেশের মানুষের কাছে তার একটাই আকুতি, বিশেষ করে লেখক ও প্রকাশকদের কাছে, তাকে যেন কিছু বই দিয়ে সাহায্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখন বইয়ের ভিক্ষুক, মানুষ যেন আমাকে বই ভিক্ষা দেন।’ জসিমউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আজকালের মানুষগুলো শুধু সার্টিফিকেটের জন্য বই পড়ে, কি হবে এসএসসি পাশ, এইচএসসি পাশ করে, যদি সঠিক জ্ঞানই না থাকলো?’ অভিভাবকরা মনে করেন, বাচ্চারা শুধু পাঠ্যবই পড়লেই যথেষ্ট, কিন্তু তা নয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন, তার পাঠাগারে হরেকরকমের ভালো ভালো বই থাকবে, মানুষ বইপড়ার জন্য পাঠাগারে ভিড় জমাবে।
কুষ্টিয়া জেলাধীন খোকসা থানার পাইকপাড়া গ্রামের ৩৩ বছর বয়সী এ ব্যতিক্রমী মানুষটির সাথে কথা বলে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি মাত্র দুই ক্লাস পড়েছেন।
তিনি মানুষকে সত্যিকারের আলোকিত মানুষ হিসেবে দেখতে চান। খুব ভালোলাগার বিষয় হলো, দেশের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা যেসব কথা বলবেন সেকথা বলেন প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে এই অল্প শিক্ষিত মানুষটি।