“আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে”
ছোটবেলায় কবি সুনির্মল বসুর “সবার আমি ছাত্র” কবিতার এ চরণগুলি আমরা কেবল বইতেই পড়তাম না, আমাদের বাস্তব জীবনের সাথেও কবিতার এ চরণগুলির অনেক মিল ছিল। কিন্তু, বর্তমানের ইট-পাথরের খাঁচায় বন্দী শিশুরা এসব কবিতা কেবল বইতেই পড়ে, তাদের জীবনের সাথে প্রকৃতির কোন সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে।
ছোটবেলায় আমরা যখন খোলা আকাশটাকে দেখতাম তখন আমাদের মনের ভাবনাগুলো আকাশের মতোই বিস্তৃত হতো। আকাশ, বাতাস, পাহাড়, চাঁদ-সূর্য একটি শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক। কিন্তু, শৈশবে শিশুকে যদি চার দেয়ালে বন্দী করে রাখা হয়, তাহলে আমরা ভবিষ্যতে কেবল একজন যন্ত্রমানব ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার বা চাকুরীজীবি পাব কিন্তু একজন খাটি মানুষ পাব না।
বর্তমানে শহরের শিশুরা জীবন-বিচ্ছিন্ন হয়ে বেড়ে উঠছে। তাদের শৈশব বন্দী ইট-পাথরের চার দেয়ালের মধ্যে। তাদের জীবন আজ রুটিন বাঁধা, বই ভর্তি ব্যাগ কাঁধে স্বুল যাওয়া,তারপর কোচিং বা টিউশনে যাওয়া এবং বাড়িতে ফিরে আবারও গৃহ শিক্ষকের সামনে পড়তে বসা। এর মধ্যে যদি কখনও কিছুটা সময় মেলে তখন টিভি দেখা, কম্পিউটার গেমস খেলা, স্মার্টফোনে গেমস খেলাই হচ্ছে একমাতো বিনোদন মাধ্যম। ফলে শহরের শিশুরা শারীরিক পরিশ্রমের খেলা ভুলে মস্তিষ্কনির্ভর খেলায় অভ্যস্ত হচ্ছে। তাছাড়া শহরে বাড়ির বাইরে কোথাও কিছুটা খেলার জায়গা থাকলেও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অভিভাবকগন সন্তানদের বাইরে খেলতে যেতে দিতে চাননা। ফলে ক্রমেই তারা স্মার্টফোন,ল্যাপটপ,ডেক্সটপ ইত্যাদির প্রতি আশক্ত হচ্ছে। ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে।
এ তো গেলো কেবল শহরের গল্প। তবে, গ্রামের গল্পটাও আজকাল খুব একটা সুখকর নয়। গ্রামে অধিকাংশ শিশুকেই পড়ার উপযুক্ত সময়টাতে তাদের মায়ের গৃহস্থলী কাজে, বাবার ব্যবসায়িক অথবা কৃষিকাজে সাহায্য করতে হয়। এবং বিকালে যখন একটি শিশু খেলবে ঠিক তখনই তাকে জোরপূর্বক পড়তে বসানো হয়। এমনিভাবে তারা হারিয়ে ফেলে তাদের শৈশবটাকে। এছাড়া গ্রামে মেয়ে শিশুরা প্রতিনিয়তই বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে তাদের পুতুল খেলার শৈশবটাকে বিসর্জন দিচ্ছে। গ্রাম অঞ্চলে মেয়ে শিশুদের কৈশোরে পা দেয়া মাত্রই তাদেরকে ঘরবন্দী করে ফেলা হয়। তারা তখন আর বাড়ির বাইরে কোথাও বেড়ানোর সুযোগ পায় না বা খেলাধূলার সুযোগ পায় না। এছাড়াও গ্রামের ছেলে শিশুরাও তেমন খেলার সুযোগ পাচ্ছে না কারন, লাল-সবুজের সোনার বাংলা থেকে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে খেলার মাঠগুলো। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে মাঠের খেলাগুলোও। ক্রমেই খোলা মাঠগুলোতে তৈরী হচ্ছে বহুতল ভবন, কলকারখানা, হিমাগার ইত্যাদি।
বর্তমানে মনোবিজ্ঞানীগন বলছেন যে, সাধারণত শিশুদের চিন্তা কাঠামো ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্র তৈরী হয় শৈশব-কৈশোরে এবং সেই অভিজ্ঞতাই বলে দেয় যে ভবিষ্যতের মানুষটি কেমন হবে। শিশুদের শৈশবের অভিজ্ঞতাকে যত বেশী সৃজনশীল করা যাবে তাদের মানসিক বিকাশও ততো ভাল হবে।
শিশুকে রুটিন বাঁধা জীবনে বন্দী করে রাখলে তাদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে তারা নানাপ্রকার হতাশায় ভুগতে পারে এবং ক্রমেই নানাপ্রকার মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এবং ভবিষ্যতে তারা নানাপ্রকার সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যেতে পারে।
শিশুদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও নতুন কিছু ভাবার ও জানার সুযোগ দিতে হবে।
কবি সুনির্মল বসু বলেছেন যে, “বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর
সবার আমি ছাত্র
নানানভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র”
অতএব কেবল বিদ্যালয় বা পুস্তকই শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে যথেষ্ট নয়, একজন শিশুকে তার আপন পৃথিবীটাকে চিনতে সুযোগ দিতে হবে। শিশুকে চারপাশের মানুষের সঙ্গে কীভাবে মিশতে হবে তা শিখাতে হবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুর একটা নিজস্ব জগত গড়ে ওঠে তাতে আমাদের বাধা দেয়া উচিৎ নয়।
শিশুকে চার দেয়ালে বন্দী করে রাখলে তাদের মনটাও চার দেয়ালের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে থাকবে। তাইতো কবি হাজেরা সাথী বলেছেন যে,
“ইট-পাথরের বন্দী ঘরে
মনটা আমার ধুকে মরে,
কোথায় গেলে শান্তি পাবো?
কেথায় পাবো ওরে।”
আসুন আমরা শিশুদের চার দেয়ালের মধ্যে যান্ত্রিক জীবনের রুটিনে বন্দী করে না রেখে তাদের মনের জানালাটাকে অবমুক্ত করে দেই। তাদের মানসিক বিকাশের কথা ভেবে তাদের একটি সুন্দর শৈশব উপহার দেই।
লেখক:
রাশেদ চৌধুরী
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী
আলোর পথে আমরা