উত্তরে পানি কমে এবার বন্যা মধ্যাঞ্চলে

0
86

এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বাড়ার পর এবার কমতে শুরু করেছে উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ নদ-নদীর পানি। তবে এবার নতুন বিপদ। বেশ কয়েকটি জেলায় বাঁধ ভেঙে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ওই এলাকাগুলোকে বন্যার ঝুঁকিমুক্ত মনে করা হচ্ছিল।
উত্তরাঞ্চল থেকে নেমে যাওয়া পানি এখন দেশের মধ্যাঞ্চলের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। এতে মধ্যাঞ্চলের কয়েকটি জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে শুরু করেছে।
প্লাবিত এলাকাগুলোতে ইতিমধ্যে ত্রাণের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় এখনো ত্রাণ পৌঁছায়নি। কিছু জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
গতকাল শনিবার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, দেশের ১৬ জেলার ৫৯টি উপজেলার প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯ হাজার ৩১৪টি ঘরবাড়ি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১২ হাজার ৩৭১টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭ হাজার ৩৭৫ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী দেশের সব রাজনৈতিক দল, বিত্তবান ব্যক্তি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোকে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আক্রান্ত এলাকায় ত্রাণের কোনো অভাব নেই। ৫ থেকে ২৯ জুলাই ১৩ হাজার মেট্রিক টন চাল পাঠানো হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বন্যা পরিস্থিতি-বিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়, এ পর্যন্ত বন্যায় ১৪ জন মারা গেছে। এর মধ্যে জামালপুরে মারা গেছে সর্বোচ্চ সাতজন। গত শুক্রবার যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার, পদ্মা, ঘাঘট, করতোয়া ও সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। দেশের বিভিন্ন নদীর ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ১৯টি পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল।
সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বাড়ায় অস্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে ৩০টি স্থান দিয়ে পানি ঢুকছে। একই সঙ্গে ওই বাঁধের শিমুলতলী এলাকায় প্রায় ৩০০ মিটার এলাকা ধসে গেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। পাউবোর কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ধস বা ভাঙনের হাত থেকে বাঁধ রক্ষায় রাতভর পাহারার জন্য পুলিশের পাশাপাশি ৪০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের পৌর মেয়র সৈয়দ আবদুর রউফ বলেন, রাতের আঁধারে কোনো দুর্বৃত্ত যদি বাঁধের সামান্য অংশও কেটে দেয়, তবে মুহূর্তের মধ্যে পানি শহরের মধ্যে প্রবেশ করবে। পাউবোর সিরাজগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, সার্বক্ষণিক মাটি ও বালু মজুত করে রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সব কর্মকর্তার ছুটি আপাতত বাতিল করা হয়েছে।
গতকাল সকালে যমুনার পানি ৪ সেন্টিমিটার বেড়ে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ওয়ালি উদ্দিন বলেন, পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় ৩৩টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দেড় হাজার বাড়িঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে গতকাল পর্যন্ত ৩৭০ মেট্রিক টন চাল এবং ১৩ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
ফরিদপুর শহরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ফাটল ধরেছে। গত শুক্রবার সদর উপজেলার আলিয়াবাদ ইউনিয়নের ভাজনডাঙ্গা খেয়াঘাট এলাকায় এ ফাটল দেখা দেয়। ফাটল মেরামতের চেষ্টা করছে পাউবো। এদিকে গতকাল সকালে বিলগজারিয়া পাকা সড়কের ৩০০ ফুট ধসে যায়। সদর উপজেলার কাদেরের বাজার এলাকায় ফরিদপুর-চরভদ্রাসন সড়কের আংশিক তলিয়ে গেছে।
রাজবাড়ী সদর, কালুখালী, পাংশা ও গোয়ালন্দ উপজেলার কমপক্ষে চার হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পাউবোর রাজবাড়ী কার্যালয় থেকে জানা গেছে, গতকাল পানি বিপৎসীমার প্রায় এক মিটার (দশমিক ৯৬ সেন্টিমিটার) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সৈয়দা নওশিন বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তার সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল দৌলতদিয়ার ঢল্লা পাড়া, আফসার শেখের পাড়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের দেবগ্রাম এবং জলিল মুন্সির পাড়ায় জেলা প্রশাসনের ত্রাণ দপ্তর থেকে জরুরি ভিত্তিতে চাল ও নগদ অর্থ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, গতকালও দৌলতদিয়ার চারটি ঘাটের মধ্যে ২টি এবং ১৮টি ফেরির মধ্যে ছয়টি ফেরি বন্ধ ছিল। এ ছাড়া তীব্র স্রোতে ফেরি চলাচলে প্রায় তিন গুণ বেশি সময় বেশি লাগায় গাড়ি পারাপার ব্যাহত হচ্ছে। দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে আটকা পড়ছে কয়েক শ গাড়ি।
যমুনার পানি বাড়ায় টাঙ্গাইল সদর, ভূঞাপুর, কালিহাতী ও নাগরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এই চার উপজেলার দুই শতাধিক গ্রামের বাসিন্দা। কয়েক হাজার একর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ভূঞাপুরের ছয়টি ইউনিয়নই বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
গতকাল পাউবোর টাঙ্গাইল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ বলেন, অভ্যন্তরীণ প্রায় ১০টি শাখানদীর পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তালিকা হাতে পেলেই দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ দেওয়া হবে।
পাবনার বেড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ইউনিয়নগুলোর আরও অন্তত ২৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
উত্তরাঞ্চলে পানি কমছে, ভাঙছে বাঁধ
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী ইউনিয়নের সিংড়িয়া এলাকায় গত শুক্রবার রাতে বাঁধ ভেঙে ৩০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পাউবোর গাইবান্ধা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ কৃষ্ণ সরকার বলেন, তিন দিন ধরে বালুভর্তি বস্তা ফেলে ঝুঁকিপূর্ণ এই বাঁধটি রক্ষায় চেষ্টা চালানো হয়। বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় পাশের সোনাইল বাঁধ ও গাইবান্ধা-সাঘাটা সড়ক হুমকির মুখে পড়েছে।
কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি সামান্য কমলেও বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৮২ সেন্টিমিটার ও ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দুর্ভোগ কমেনি নয় উপজেলার সাড়ে ছয় লাখ বানভাসি মানুষের। পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে দুই শিশুর। চিলমারীর রানীগঞ্জ ইউনিয়নের বুরুজের পাড়া এলাকার সড়ক, থানাহাট ইউনিয়নের ঠগেরহাট বাজার এলাকায় একটি সেতুসহ পাকা সড়ক ভেঙে যাওয়ায় উপজেলা সদর প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমীর আলী বলেন, কলেজ-পাড়া গ্রামের সাথী (৮) নামের এক শিশু গত শুক্রবার কলাগাছের ভেলা থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। এ ছাড়া নাগেশ্বরী উপজেলার হাছনাবাদ ইউনিয়নের সোলায়মান আলীর কন্যা খাদিজা (১৪) শনিবার সকালে বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে।
রৌমারীর ডিগ্রীর চর, ধলার চর ও বাঘমারা এলাকায় বাঁধ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া স্থানীয় রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। উলিপুরে বন্যার পাশাপাশি দেখা দিয়েছে ব্যাপক ভাঙন।
জেলা বন্যা নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল মোত্তালিব মোল্লা বলেন, জেলার নয় উপজেলার ৫৭টি ইউনিয়নের ৭২৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ১ হাজার ১৮৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা পানিতে ডুবে আছে। পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ ও কালভার্টের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯টিতে। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার পরিমাণ ৫২৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৩ দশমিক ৩০ কিলোমিটার। এ পর্যন্ত বন্যাদুর্গত এলাকায় ১ হাজার ৭৫ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও ৩৪ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে; যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের খানপাড়া গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে সূচনা (৩) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র ও দশআনী নদীর পানি বাড়ায় গতকাল শেরপুরের সদর উপজেলার তিন ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। শেরপুর-জামালপুর মহাসড়কের কয়েকটি স্থান উপচে প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন।

LEAVE A REPLY